কাজী ফারজানা বেগম: বিগত কয়েক বছরে বিশ্বব্যাপী বিলিয়নের মতো শিশু শারীরিক, যৌন, বা মানসিক নির্যাতন বা অবহেলার শিকার হয়েছে বলে মনে করা হয়। অপব্যবহার, যার মধ্যে রয়েছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, যেমন- নবজাতক, শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের অবহেলা করা, শারীরিক, যৌন এবং অ-সম্মতিমূলক যৌন যোগাযোগ সম্পূর্ণ বা চেষ্টা করা হোক না কেন যৌন সহিংসতা হিসাবে বিবেচিত হয়। অপরদিকে, একটি শিশুর চলাফেরা সীমিত করা, অবজ্ঞা, উপহাস, হুমকি, ভীতি প্রদর্শন, বৈষম্য, প্রত্যাখ্যান এবং অন্যান্য অ-শারীরিক প্রতিকুল আচরণ মানসিক বা মনস্তাত্ত্বিক সহিংসতার উদাহরণ। শৈশবকালে সহিংসতার সংস্পর্শ, সারাজীবন একজনের স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার উপর প্রভাব ফেলে। বিশ্বের অন্যান্য জায়গার শিশুদের মতো বাংলাদেশের শিশুরাও সহিংস পরিবেশে বাস করে। তবুও শিশুরা তাদের বাড়িতে, পাড়ায়, স্কুলে এবং কর্মক্ষেত্রে ধর্ষণ, নরহত্যা এবং নির্যাতন সহ বিভিন্ন ধরণের সহিংস কাজের সম্মুখীন হয়। যারা এই অপরাধ করে তারা অপরিচিত, পিতা-মাতা বা অন্যান্য যতœশীল হতে পারে। বিশেষ করে পাচারের শিকার, যৌনকর্মীদের শিশু, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, জাতিগত বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সদস্য, উদ্বাস্ত, এইডস রোগী এবং দলিত (অস্পৃশ্য) শিশুরা অন্যান্য শিশুদের তুলনায় বেশি সংবেদনশীল। যে শিশুরা কাজ করে তারা প্রায়ই ভয়ঙ্কর যন্ত্রণার শিকার হয়, যার ফলে প্রায়শই তাদের মৃত্যু হয়।
শিশু নির্যাতন ব্যাপকভাবে শিশু, সম্প্রদায় এবং সামগ্রিকভাবে দেশগুলির উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। শিশু নির্যাতন মৃত্যু এবং গুরুতর আঘাতের ঝুঁকি বাড়ায় এবং তাদের স্নায়বিক সিস্টেমের বিকাশকে ব্যাহত করতে পারে। নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবিলা করার পদ্ধতি, একজনের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কার্যকলাপ, অপরিকল্পিত গর্ভধারণ এবং এইচআইভির মতো মারাত্মক রোগ হতে পারে। যে সকল শিশুরা এই ধরণের সহিংসতার সম্মুখীন হয়, তারা একটি দুষ্টচক্রে আটকে যেতে পারে যা পরবর্তী প্রজন্মের পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছানোর সম্ভাবনাকে বাঁধা দেয়।
চাইল্ড রাইটস এ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশ (CRAC,B) এর তথ্য অনুসারে শিশু অধিকারের উপর সার্বজনীন পর্যায়ক্রমিক পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ২০১৭ সালের প্রথম আট মাসের (জানুয়ারী-আগষ্ট) ২২২ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে এবং ১,১৪১ জন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে ২০১৩ এবং ২০১৬ এর মধ্যে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (BSAF) মতে ২০১৯ সালে ৪,৩৮১ জন শিশু বিভিন্ন ধরণের নির্যাতন ও শোষণের শিকার হয়েছে, যাদের মধ্যে ১,৩৮৩ জন যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। শুধু এটি নয়, বাংলাদেশেও অনলাইনে যৌন হয়রানি সাধারণ হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে তরুণীদের জন্য। বাংলাদেশে CRAC, B -এর মতে অল্পবয়সী মেয়েরা ক্রমশ অনলাইন যৌন নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হচ্ছে। অনলাইনে অপব্যবহারের দশ থেকে বারোটি অভিযোগ প্রতিদিন পুলিশের কাছে দায়ের করা হয়। যে সব মেয়েরা প্রি-টিন এবং কিশোর বয়সী তারা প্রায় ৯০% শিকার হয়। আরও বেশি করে মেয়েরা স্পষ্ট ছবি এবং ভিডিও প্রকাশ করার জন্য প্রতারিত হচ্ছে, যা পরে ব্ল্যাকমেইলের জন্য লিভারেজ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। বেশিরভাগ সময় বিভিন্ন কারণে ঘটনার প্রকৃত সংখ্যা রেকর্ড করা হয় না। সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সচেতনতা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাবের কারণে এই ধরণের দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে লড়াই করা বাধাগ্রস্ত হয়। বিশেষত সংখ্যালঘু এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের গোষ্ঠীর শিশুদের মূল্য ধারায় যুক্ত করার জন্য একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা তৈরী করা প্রয়োজন। আমাদের একটি মিডিয়া-চালিত প্রচার কার্যক্রম অবিলম্বে করতে হবে, যাতে করে শিশু নির্যাতনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে পিতা-মাতা শিক্ষাবিধ এবং অন্যান্য যতœশীলদের শিক্ষিত করা যায়।
শিশু আইন কিভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে সেদিকে নজর রাখা, শিশু সহায়তা ডেস্ক তৈরী, প্রতিটি থানায় শিশুদের জন্য নিবেদিত পুলিশ অফিসার নিয়োগ এবং নির্যাতিত শিশুদের দেখাশোনা করার জন্য প্রবেশন অফিসারদের ব্যবহারে বিশেষ মনোযোগ দেয়া উচিত। বাংলাদেশে শিশু নির্যাতনের উচ্চ হারের পরিপ্রেক্ষিতে, প্রতিটি শিশুর জন্য আইনী ব্যবস্থা এবং সকল স্তরের অন্তর্ভূক্তি ও জবাবদিহিতা নিশ্চয়তা দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
Leave a Reply