বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও মাতৃদুগ্ধ ভাতার কার্ড নয়ছয়, টিসিসির মাল বিক্রি এবং সরকারের ১০ টাকা মূল্যের চালের কার্ড স্বচ্ছল ব্যক্তির মাঝে বিক্রি করে অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগের প্রমাণও দিয়েছেন এলাকাবাসী। কিন্তু বিষয়গুলো তদন্তের জন্য মাঠে না গিয়ে মনমতো তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে অভিযুক্তকে রক্ষার পাঁয়তারা চলছে। ফলে বহাল তবিয়তে ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
বলছিলাম নড়াইলের লোহাগাড়া উপজেলার মল্লিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৯নং ওয়ার্ডের সদস্য ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত নুরুজ্জামান ফকির নেলনের কথা।
জানা গেছে, সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নড়াইলের লোহাগাড়া উপজেলায় তিনজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বদলি হয়েছেন। এখন যিনি আছেন তিনিও নতুন। ফলে তারা বিষয়গুলো জানেন না। এরই মাঝে ওপরের মহল থেকে ফকিরের বিষয়টির ব্যাপারে জানতে চাইলে তড়িঘড়ি করে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।
কয়েক মাস আগে ভুক্তভোগী বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ছাড়াও জেলা প্রশাসক বরাবরে অভিযোগ পড়ে নড়াইল লোহাগাড়া উপজেলার মল্লিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নুরুজ্জামান ফকিরের বিরুদ্ধে। এরপর জেলা প্রশাসক সেটি তদন্তে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেন। সেই কর্মকর্তা দায়িত্ব দেন তার অধীনস্থ স্থানীয় সরকার কর্মকর্তা শরীফুল ইসলামকে। কিন্তু শরীফুল অভিযোগ পাওয়ার পর থেকে গড়িমসি করতে শুরু করেন। গত চার মাসে তাকে দুই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা যতবার বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন ততবারই তিনি আজ দেব, কাল দেব বলে সময় ক্ষেপণ করেছেন। তবে সম্প্রতি ঊর্ধ্বতনের চাপে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছেন বলে জানা গেছে, যা তিনি নিজেও স্বীকারও করেছেন।
এবিষয়ে লোহাগাড়া উপজেলা স্থানীয় সরকার কর্মকর্তা শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। যারা অভিযোগ দিতে এসেছিলেন তাদের ভাষ্য নেওয়া হয়েছে। তবে তদন্ত প্রতিবেদনে কী লেখা হয়েছে এটা বলা যাবে না। আপনারা এ বিষয়ে ডিসি অফিসে কথা বলেন।’
এ বিষয়ে ভুক্তভোগীরা বলছেন, আমরা অভিযোগ দিয়ে এলাম, কিন্তু তারা আমাদের গ্রামে এলেন না। কথা বললেন না। তাহলে কিসের ভিত্তিতে প্রতিবেদন জমা দিলেন। আমরা মনে করি, এই প্রতিবেদন মেম্বারকে রক্ষার জন্য দেওয়া হয়েছে। এটা আমরা মানি না। তারা জেলায় বিচার না পেলে ঢাকার দুদকে অভিযোগ করবেন বলেও জানান।
এলাকায় অভিযোগ উঠেছে, উপজেলাটির স্থানীয় সরকার কর্মকর্তা শরীফুল ইসলামকে ইউপি সদস্য নুরুজ্জামান ফকির লাখ টাকায় ম্যানেজ করেছেন। যা এলাকায় বলেও বেড়াচ্ছেন মেম্বার ও তার লোকজন। কেউ তার দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে এমন কথা তুললেই তাকে সাফ জানিয়ে দিচ্ছেন, তার কিছুই হবে না। কারণ তিনি স্থানীয় সরকার কর্মকর্তা শরীফকে লাখ টাকা দিয়ে এসেছেন। তার বিরুদ্ধে তিনি কোনো ধরনের প্রতিবেদন দাখিল করবেন না। ফলে তার কিছুই হবে না।
মল্লিকপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, ‘সে (মেম্বার নুরুজ্জামান ফকির) আমার কাছে এসে বলছে, সব ম্যানেজ করে ফেলছে। তার কিছু হবে না। আমরা তো অবাক। যে লোকটা এত কিছু আত্মসাৎ করল, টাকা লুট করল, তার কিছুই হবে না।’
কয়েক মাস আগে ইউপি সদস্য নুরুজ্জামান ফকির নেলনের বিরুদ্ধে এলাকাবাসী খুলনা বিভাগীয় অফিস, জেলা, উপজেলা এবং স্থানীয় সরকার বরাবরে নানা অভিযোগ জানায়। সেসব অভিযোগে তারা তার বিরুদ্ধে টিসিবির চাল চুরি, বয়স্ক ভাতা, গর্ভবতী মায়ের কার্ড ভাতা ও ১০ টাকার চালের কার্ড স্বচ্ছল মানুষদের মাঝে বিক্রি করে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করেন। সেই সাথে তারা বিষয়গুলো তদন্তেরও জোরালো দাবি তুলে তার শাস্তি দাবি করেন।
এসব বিষয়ে ইউপি সদস্য নুরুজ্জামান ফকির নেলনের দাবি, সব অভিযোগ মিথ্যা। তার বিরুদ্ধে একটি মহল বিভিন্ন দফতরে এসব মিথ্যা অভিযোগ জমা দিয়েছে।
মল্লিকপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের মিলন খান তার মেয়ের জন্য মাতৃদুগ্ধ ভাতার কার্ড চেয়েছিলেন। কিন্তু নুরুজ্জামান ফকির সেই কার্ড বাবদ তার কাছে ১০ হাজার টাকা দাবি করেন। এরপর মিলন খান বিষয়টি চেয়ারম্যান বরাবর জানালে মেম্বার কার্ডের আবেদন জমা নেন, কিন্তু সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি। চলতি বছর মিলন খানের সাথে এমন ঘটনা ঘটে বলে জানান তিনি।
মিলন খান বলেন, ‘এটাতো আমার প্রাপ্য। আমি খেটে খাওয়া মানুষ। মাতৃদুগ্ধ ভাতার ২৮ হাজার টাকা নেওয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা কোথায় পাবো?’
অভিযোগ রয়েছে— মাতৃদুগ্ধ ভাতা কার্ড এই ইউনিয়নের বাইরে অর্থাৎ অন্য ইউনিয়নেও বিক্রি করা হয়েছে। তারা এই ইউনিয়নের লোক হিসেবে ভাতা উত্তোলন করেন।
৯নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা শরীফ মোস্তফা আহ্কাম বলেন, ‘ইউপি সদস্য নুরুজ্জামান ফকির নেলনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের শেষ নাই। দীর্ঘ ১৫-১৬ বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে এবং আওয়ামী লীগ ঘরানার হওয়ায় স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহায়তায় ব্যাপক দুর্নীতি করে সম্পদ অর্জন করেছেন।’
একটি দুর্ঘটনায় কোমরে আঘাত পান একই ওয়ার্ডের বাসিন্দা ফরিদ খান। এরপর থেকে তিনি তেমন হাঁটাচলা করতে পারেন না। ইউপি সদস্য নুরুজ্জামান ফকিরের আগে এক নারী ইউপি সদস্য ফরিদ খানকে একটি ১৫ টাকা কেজি চালের কার্ড করে দিয়েছিলেন। কিন্তু নুরুজ্জামান ফকির নির্বাচিত হওয়ার পর সেই কার্ড বাতিল করে দিয়েছেন।
ফরিদ বলেন, ‘আমার দুই ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। খুব কষ্টে সংসার চালাই। এক নারী মেম্বার ১৫ টাকার কার্ড একটা দিছিল, সেটাও কাইড়া নিছে। এ বিচার কার কাছে দেব, কন?’
Leave a Reply